বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪

ক্রিকেট শুধু বাউন্ডারি লাইনে আটকে থাকে না

অঘোর মন্ডল

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০২:২১ অপরাহ্ন

ক্রিকেট শুধু বাউন্ডারি লাইনে আটকে থাকে না

সমাজ মাধ্যমে প্রতিদিন কত কিছু দেখছি। পড়ছি। দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে,পারিপাশ্বির্কতা নিয়ে। মানুষের মনে কত ক্ষোভ! কত হতাশা! মনে হচ্ছে আশপাশের মানুষগুলোর জীবন থেকে ‘আশা’ শব্দটাই স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া প্রকল্পে ঢুকে পড়েছে!

কিন্তু আবেগ? সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো ওষুধ বাঙালির জানা নেই। বাঁধভাঙা আবেগ আর উচ্ছ্বাসের কোনো ঘাটতি নেই। সেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো প্রভাব পড়েনি। বাঙালির আবেগের দাম ডলারের চেয়েও চড়া। সেটা খুব ভালোভাবে টের পাওয়া যায়, কোন ক্রিকেট ম্যাচ হলেই।

দল হারলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভেসে যায়; গণবিশেষজ্ঞের মতামতে! দল দিলে সেটা নিয়েও চলে কাঁটাছেড়া। আর তার জন্য ব্যবহার করা হয় আবেগের ছুরি-কাঁচি! বাঙালি কেন জানি বাস্তবের রুক্ষ জমিনে পা রেখে হাঁটতে চায় না! চারপাশে চোখ রাখতে চায় না!

আম জনতার কথা বাদ দিন। বড় বড় পদপদবি নিয়ে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় বসে থাকা মানুষগুলো মাঝে মধ্যে যা বলেন, তাকে মর্মান্তিক এবং মর্মস্পর্শী মনে হয়! এই যে এশিয়া কাপ ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কা ম্যাচের আগে বাংলাদেশের টিম ডিরেক্টর যা বললেন, তারপর যা ঘটলো এবং তিনি যা উত্তর পেলেন, তাকে কী বলবেন! ‘আমাদের তো দু'জন বিশ্বমানের বোলার আছে। লংকানদের তো তাও নাই!’ যাদের কিছু নাই সেই দলটাই চ্যাম্পিয়ন হলো। আর ভদ্রলোক দেশে ফিরেও দল নিয়ে কথা বলেই যাচ্ছেন!
শ্রীলঙ্কা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সে দেশের মানুষের উদ্বেলিত মনের ছবি দেখার জন্য এক্স-রে কিংবা সিটি স্ক্যান রিপোর্টের দরকার হয় না। শুধু অনুভূতি থাকলেই উপলব্ধি করা যায়। শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক শনাকা শিরোপা উঁচিয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘চারপাশে অনেক খারাপ কাণ্ড-কারখানা ঘটছে। কিন্তু ক্রিকেটারদের ওপর বিশ্বাস রাখুন। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে জানি। ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এই ট্রফিটা গোটা শ্রীলঙ্কাবাসীর। এরকম একটা কিছুর জন্য তারা অপেক্ষা করছিলেন।'

আমরা কেন আমাদের ক্রিকেটারদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছি না? ব্যাখ্যাটা একপাক্ষিক হতে পারে না। দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য নেই ক্রিকেটারদের। আবার দেশের মানুষও খুব অস্থির হয়ে পড়েন। ধৈর্য হারা হয়ে যান। সাফল্য ছাড়া তারা কিছু বুঝতে চান না!

তবে এটা ঠিক, আমরা সাফল্যহীন সময়ের উজান ঠেলে চলেছি। এই উপমহাদেশের দলগুলো বড় বড় সাফল্য পাচ্ছে, আর আমরা বলছি আমাদের সময় লাগবে। আরও কিছুটা সময় দিন। বিশ্বকাপ শুরুর নয় বছরের মধ্যে ভারত চ্যাম্পিয়ন হলো। তার এগার বছর পর পাকিস্তান শিরোপা জিতলো। পাকিস্তানের পরই জিতলো শ্রীলঙ্কা। ’৮২তে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার চৌদ্দ বছরের মাথায় ক্রিকেট বিশ্বকে বিস্মিত করে দিয়ে লঙ্কানরা কাপ জিতেছিল। আর আমরা? বাইশ বছর পার করে দিলাম টেস্ট আঙিনায়। কিন্তু কোনো ট্রফি নেই!

এবার শ্রীলঙ্কা যে অবস্থা থেকে এশিয়া কাপ জিতলো, তাকে অরবিন্দ ডি-সিলভার মতো সাবেক তারকা বলছেন, ‘ছিয়ানন্বইয়ের বিশ্বকাপ জয়ের থেকে এবারের এশিয়া কাপ জয়ের তাৎপর্য কোনো অংশে কম নয়।’ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে ডি-সিলভার কথাটাও অনেক তাৎপর্য বহন করে। সংকটের সময়ও তারা তাদের দেশের মানুষের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পেরেছেন।

দেশটাকেও অনেকাংশে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। দৃঢ়সংকল্প, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা, খেলাটার প্রতি নিবেদিত প্রাণ হলে এরকমভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে সব চ্যালেঞ্জ জেতা যায়। শিরোপা জিততে অতিমানব হওয়ার দরকার নেই। দরকার অনুশাসন, অনুশীলন, জেতার উদগ্র ইচ্ছে। দরকার জীবনের মঞ্চে কঠিন পরিস্থিতিকে জয় করার তীব্র একমুখিতা।

একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুধু বাউন্ডারির দড়ির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। আমরা এটা বুঝতে চাই না। না ক্রিকেটাররা। না দর্শকরা। ক্রিকেট প্রতিদিন অনেক শিক্ষা দিয়ে যায়। জীবনে জীবন যোগ করার শিক্ষা দেয়। কিন্তু আমরা শিক্ষা নেই কী? যদি নিতাম তা হলে কী আমাদের বড় এক ক্রিকেট কর্তা বলতে পারেন, ‘ওদের (শ্রীলঙ্কা) দলে কোনো বিশ্বমানের বোলার নেই!’

ক্লাইভ লয়েডের বিশ্বজয়ী দলের সামনে ’৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালের দলটা কেমন ছিল? কিন্তু কাপটা তো কপিল দেবের ভারতই জিতেছিল। এবারের এশিয়া কাপ জয়ের পর শ্রীলঙ্কা দলের বাইশ বছর বয়সী ক্রিকেটার মহেশ টিকসানার করা টুইটা কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে রাখতে পারছি না। তিনি লিখেছেন ‘নো নিড টু হ্যাভ ওয়ার্ল্ড ক্লাস প্লেয়ার্স, হোয়েন ইউ হ্যাভ ইলেভেন ব্রাদার্স।’

বিশ্বমানের প্লেয়ার দরকার নেই। ১১টা ভাই থাকলেই হয়। আসলেই তাই সংকট সময়ে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত রাখার সৌভ্রাতৃত্ব একাদশ। এরকম এগারজনেক কবে পাবে বাংলাদেশ? আমাদের বিশ্বসেরা ক্রিকেটারের চেয়ে দরকার ওরকম এগারজন ক্রিকেটার। যারা হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ রেখে লড়বেন।

অঘোর মন্ডল: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক


সর্বশেষ

উপরে নিয়ে চলুন