আমাদের সেই আগ্রাসী আফতাব, আমাদের সেই আলসে বালক আফতাব এবং প্রায়-বন্ধু আফতাব নাকি এখন আমেরিকার আফতাব।
মাঝরাতে ফোনের ওপাশ থেকে চেনা হাসিটা হেসে বললেন, ‘তাই কী হয়? শেষ পর্যন্ত আমি আপনাদেরই আফতাব।’
আফতাব আহমেদের পরিচয় কী?
কার্ডিফে জেসন গিলেস্পিকে উড়িয়ে মারা সেই ছক্কা। অজিত আগারকার, জহির খানদের তুলোধোনা করা। কিংবা ক্যারিয়ারের প্রথমবার বল করতে নেমেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট তুলে নেওয়া।
আফতাব ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক ক্রিকেটে প্রথম সত্যিকারের পাওয়ার হিটার। ছোট্ট ক্যারিয়ারটা স্বাক্ষ্য দেবে, কী অবলীলায় বিশ্বসেরা বোলার পেটাতেন। একটু স্থায়ী হলেই বিশ্বসেরাদের খাতায় না হোক, দেশসেরা তো হতেন।
কিন্তু আফতাবও হারালেন।
আফতাব অবশ্য অন্য কারো দোষে হারাননি। বোর্ড, কোচ, সতীর্থ; কেউ আফতাবকে হারাতে চায়নি। আফতাব নিজেই এসেছিলেন হারিয়ে যেতে। এই ক্রিকেটের ঝকমারি প্রতিযোগিতা আর ‘অনর্থক’ পরিশ্রম তার ভালো লাগতো না। তাই ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতেন।
বিশ্বাস করুন, এমনও হয়েছে যে, আফতাবকে দলে নেওয়া হয়েছে; কিন্তু তাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও নেই তিনি। ২২তম বারের মত হয়তো সিম চেঞ্জ করে নিজের কোনো দুনিয়ায় চলে গেছেন। তার ইচ্ছে করতো না এই কৃত্রিম লড়াইয়ে নামতে।
একবার এক স্বাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘কী হবে? এই পরিশ্রম করে, রোজ সকালে উঠে প্র্যাকটিস করে কী লাভ? ওর চেয়ে শান্তিতে জীবন কাটানো অনেক ভালো।’
সেই আফতাব এখন উদায়স্ত ছুটছেন ক্রিকেটের জন্য।
মাত্র ২৪ বছর বয়সে শেষ হয়ে যায় তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। বয়স তিরিশ স্পর্শ করার আগে সব ধরনের ক্রিকেট ছেড়ে কোচিং শুরু করেন। নিজে একটা অ্যাকাডেমিও করেছিলেন। সেসব কচিকাচা বাচ্চাদের নিয়ে বেশ ছিলেন। এর মধ্যে গতবছর চলে গেলেন আমেরিকা।
ওখানে আটলান্টা ফায়ারের হেড কোচ হিসেবে কাজ করছেন। এখন দলটা মাইনর লিগে খেলছে। মেজর লিগে দল যাবে। সেটাতেও হেড কোচ থাকবেন আফতাব। তবে এতে রুটি রুজি করা কঠিন। তাই আফতাব পার্ট টাইম হিসেবে অন্তত পাঁচ জন ক্রিকেটারকে ‘প্রাইভেট কোচিং’ করান। এর বাইরে ইন্ডিয়ান একটা অ্যাকাডেমিতে সময় দেন।
প্রতিদিন ভোর রাতে গাড়ি নিয়ে ছোটা শুরু হয়। সন্ধে অবধি কাজ করেন। এরপর নিজের ফিটনেস নিয়ে কাজ করেন। খেলাও শুরু করেছেন টুকটাক। মানে, অবিশ্বাস্য পরিশ্রম করছেন সেই ক্রিকেট নিয়ে।
বছর দশ-পনেরো আগে এই পরিশ্রমটা করলে ইতিহাসই হয়তো অন্যরকম হতো। একটা কোচিং থেকে বেরিয়ে আফতাব হেসে বলেন, ‘আসলেই, দাদা। আসলেই সত্যি। বুঝতে পারিনি। জীবনে কখনো না কখনো যে এমন ছুটতে হবে, কল্পনা করতে পারিনি। সেই সময় যদি এই পরিশ্রম করতাম, খামখেয়ালী না করতাম, আসলেই সবকিছু হয়তো অন্যরকম হতো।’
যাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে, আফতাব। এবার আমেরিকান আফতাবকে নিয়ে গর্ব করতে চাই। মেজর লিগে দলকে চ্যাম্পিয়ন করে দেখিয়ে দেন, ভাই।
লেখক : ক্রীড়া লেখক ও সিনিয়র সাংবাদিক, নগদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।