চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বুড়িশ্চরের সন্তান পেশায় ডাক্তার, নেশায় পাহাড়ি ডা. বাবর আলী। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট ও লোৎসে পর্বত অভিযান শেষে ঠিক দু’মাস পর ঘরে ফিরেছেন দেশের ষষ্ঠ এভারেস্ট জয়ী ডা. বাবর আলী। বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার একই অভিযানে হিমালয়ের দুইটি ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বত শৃঙ্গ জয়ের কীর্তি কেবলেই চট্টগ্রামের সন্তান বাবরের।
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বত এভারেস্টের চূড়ায় বাবর আলী এক ঘণ্টা ১০ মিনিট ছিলেন। এভারেস্ট জয়ের পর নেমে আসার সময় আহত এক পর্বতারোহীর জন্য মানবজটে ছিলেন দেড় ঘণ্টা। এ সময় শুরু হয় তুষার ঝড়। ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করেন আড়াই ঘণ্টা। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
বুধবার (২৯ মে) চট্টগ্রামের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে এভারেস্ট জয়ের গল্প শোনাতে গিয়ে এভাবেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘আমার এভারেস্ট সামিটের অভিযানটি ছিল দুই মাসের। আজ এভারেস্ট ডে। ১৯২৪ সালে জর্জ মেলোরি মহাকাব্যিক অভিযান ছিল। একশ বছর পর আমি এভারেস্ট আরোহন করতে পেরেছি। আগামীকাল (৩০ মে) আমাদের ভার্টিকাল ড্রিমস ক্লাবের ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এমন একটি দিনে আজ আপনাদের সামনে আমার অভিযানের বিষয় তুলে ধরতে পেরে আমি দারুণ আনন্দিত।’
তিনি বলেন, ‘কেউ যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিং দেখতে চায় তাকে হিমালয় যেতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আশাপাশে অনেকগুলো লেক সৃষ্টি হয়েছে। তুষারপাতহীন অবস্থায় ব্লু আইস বেরিয়ে আসছে। এতে পর্বত আরোহণ কঠিন হয়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে আশাপাশের পরিবেশ প্রতিবেশে বেশ বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন দেখার উত্তম স্থান হিমালয়। এটা শুধু পর্বত আরোহণ আর নয়, পরিবেশ রক্ষায় সিদ্ধান্তগ্রহণের গবেষণার স্থানও।’
শরীর উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য উপরে পৌঁছে নিচে নেমে ঘুমাতেন বাবর। তিনি জানান, ‘ক্যাম্প ৪ এবং এর উপরে পর্বাতারোহীরা অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করলেও চেষ্টা করেছেন অভিযানে যতটা সম্ভব কম কৃত্রিম অক্সিজেন নিতে। কারণ তিনি স্বপ্ন দেখেন আগামীতে অক্সিজেন সহায়তা ছাড়াই কোনো আটহাজারী শৃঙ্গ আরোহন করা।’
বাবর বলেন, ‘এভারেস্টের উচ্চতা বেশি হলেও লোৎসে আরোহন তুলনামূলক কঠিন। সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছি এটা আমাকে আনন্দ দিয়েছে। চার কেজি ওজন কমেছে।’ এভারেস্ট ও লোৎসের চূড়া থেকে দেখা নিচের পৃথিবীর দৃশ্য এ জীবদ্দশায় ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানান বাবর।
বাবর জানান, দুই পর্বতে সঙ্গে ছিলেন নেপালের গাইড বাইরে তামাং। গত ১০ এপ্রিল বেস ক্যাম্পে পৌঁছি। কুমু আইসফলের (বরফের প্রপাত) রাস্তা তখনো ওপেন হয়নি। এ সড়কটি অ্যালুমিনিয়াম সিঁড়ি দিয়ে পার হতে হয়। প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। একজনকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করতে হয়েছিল। এবার ব্লু আইস বেড়ে যায়।’
তিনি জানান, ‘এভারেস্টে অনেক মরদেহ দেখেছি। এর মধ্যে অনেক ইকুইপমেন্ট নতুন, তারা মারা গেছে বেশিদিন হয়নি। এভারেস্ট সামিট করার ক্ষেত্রে আবহাওয়া বড় ফ্যাক্টর। বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদ (বর্তমানে কানাডায় আবহাওয়া নিয়ে পিএইচডি গবেষণারত) মোস্তফা কামাল পলাশ আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন।’
এই প্রতিনিধির এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শিগগির চাকরিতে যোগ দেবেন জানিয়ে বলেন, ‘চিকিৎসাবিদ্যা ছাড়া কোনো আর্ট জানি না। তাই চাকরি নিতে হবে। সঞ্চয় দিয়ে পর্বতারোহনের নেশা পূরণ করতাম। আমার মনে হয়, এভারেস্ট জয় করার চেয়ে কঠিন এর জন্য তহবিল জোগাড় করা। পৃষ্ঠপোষক পাওয়া। আমি এবার স্পন্সরের কাছে গেছি। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি মনে করি, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের অনেক তরুণ এভারেস্ট জয় করতে পারবে।’
শিখর থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে নেমে আসেন বাবর। বেসক্যাম্প থেকে কাঠমান্ডু ফিরেন মাত্র ৩ দিনে। নিজের সফলতার পিছনে এই পর্বতারোহী কৃতিত্ব দেন নিজের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমকে।
এছাড়াও তিনি কৃতজ্ঞতা জানান নিজের ক্লাব ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’, সকল পৃষ্ঠপোষক সংগঠন এবং ক্রাউড ফান্ডিং এ অংশ নেওয়া সকল শুভাকাঙ্খীদের।
এই অভিযানের প্রধান অভিযান সমন্বয়ক ফরহান জামান অভিযানের পিছনের গল্প সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরে বলেন, ‘পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা পেলে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের পর্বতারোহীরা আরও অনেক দুর্দান্ত কীর্তি বয়ে আনতে পারবে’।
বাবর আলীর সফলতা উদযাপনে আগামী ২ জুন চট্টগ্রাম নগরীতে বিকাল ৫টায় অনুষ্ঠিত হবে চট্টগ্রামের সাইক্লিস্টদের অংশগ্রহণে সাইকেল শোভাযাত্রা এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে বাবর আলী নিজের অভিযানের গল্প শোনাবেন চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে। জাতীয় পতাকা প্রত্যপর্ণের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সভাপতি দেবাশীষ বল, প্রধান উপদেষ্টা শিহাব উদ্দিন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এন ফয়সাল।