এশিয়া কাপের ফাইনালের রাত। দুবাই এমনিতে আলোকজ্জ্বল শহর। সেখানে আয়োজন হচ্ছে এশিয়ার ক্রিকেট যুদ্ধের ফাইনাল লড়াই। যেখানকার বেশিরভাগ দর্শক আবার পাকিস্তানের সমর্থক। পাকিস্তানি সমর্থকেরা বিজয়োল্লাসের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন; ভেবেছিলেন রোববারের রাতটি হতে তাদের, একান্তই তাদের। রাতটা শ্রীলঙ্কার হওয়ার কথা ছিল না। এশিয়া কাপটাও শ্রীলঙ্কার হওয়ার কথা ছিল না হয়তো।
এ টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল শ্রীলঙ্কাতেই। তবে দেশটি এমন অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত যে এতগুলো দলকে আতিথেয়তা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। যে কারণে নিজেদের দেশে খেলার বদলে খেলতে হলো পরভূমে। টুর্নামেন্টে শুরুটা হলো দুঃস্বপ্নের মতো। আফগানিস্তানের বিপক্ষে আগে ব্যাটিং করে গুটিয়ে গেল ১০৫ রানে, প্রতিপক্ষ যেটি পেরিয়ে গেল ১০.১ ওভারের মধ্যে। এর পরের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ। যে দলের টিম ডিরেক্টর বলেছিলেন, শ্রীলঙ্কা দলে কোনো বোলারই দেখেন না তিনি। শ্রীলঙ্কা মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে, পিছিয়ে ছিল সবখানেই।
এরপর আজকের ফাইনাল। দুবাইয়ে যখন টস জিতলেই ম্যাচ জয় অনেকটাই নিশ্চিত, টানা চার ম্যাচ জেতার পর সেই টস হারলেন শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক। পাকিস্তান পেসারদের সামনে এলোমেলো হয়ে পড়ল তাদের ব্যাটিং—৪ ওভারের মধ্যে ফিরে গেলেন দুই ওপেনার, টুর্নামেন্টে দলের ৪৫ শতাংশ রানই যাঁদের। এরপর ৫৮ রানে নেই ৫ উইকেট।
ফাইনালে মাঠে শ্রীলঙ্কা পিছিয়ে পড়ল আরেকবার। তবে ভানুকা রাজাপক্ষে, ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা হার মানলেন না। হাসারাঙ্গা করলেন ২১ বলে ৩৬ রান, রাজাপক্ষে খেললেন ৪৫ বলে ৭১ রানের অপরাজিত ইনিংস, পঞ্চম ও ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ৬৭ বলে শ্রীলঙ্কা তুলল ১১২ রান। প্রথম ১০ ওভারে যে দলের রান ছিল ৫ উইকেটে ৬৭, শেষ ১০ ওভারে মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে তারাই তুলে ফেলল ১০৩ রান!
তারপরও ১৭০ এমন কোনো স্কোর নয়, বিশেষ করে পরে ব্যাটিং করলে। দুবাইয়ে পরে ব্যাটিং করা মানেই জয়, শ্রীলঙ্কাও এই টুর্নামেন্টে ৪টি জয় পেয়েছে এভাবেই। এ বছরেই একটি ম্যাচও জেতেনি তারা প্রথমে ব্যাটিং করে। বিরতির সময় তাই ফেবারিট ছিল পাকিস্তানই। এরপর প্রথম বৈধ বল করার আগেই শ্রীলঙ্কার তরুণ পেসার দিয়ে বসলেন ৯ রান।
তবে আবার ঘুরে দাঁড়াল তারা। প্রায় নিখুঁত ফিল্ডিং, চাপের মুখেও দারুণ বোলিং, দুর্দান্ত অধিনায়কত্ব—শ্রীলঙ্কা রাতটা করে নিল নিজেদের। ১৭০ রান করে ২৩ রানে জিতে ষষ্ঠবারের মতো এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন তারাই।
চতুর্থ ওভারে মাদুশানের পরপর দুই বলে ফর্ম খুঁজে ফেরা বাবর আজম ও ফখর জামান ফেরার পর সতর্ক হয়ে পড়েন মোহাম্মদ রিজওয়ান ও ইফতিখার আহমেদ। দুজনের জুটিতে ওঠে ৭১ রান, তবে তাঁরা খেলে ফেলেন ৫৯ বল। যতক্ষণে মাদুশানের ওপর চড়াও হতে গিয়ে ইফতিখার ফিরেছেন, পাকিস্তানের তখন প্রতি ওভারে দরকার ১২-এর বেশি করে রান।
ইফতিখার ফেরার পর শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক দাসুন শানাকার দুটি সিদ্ধান্ত এরপর কাজে লেগেছে দারুণভাবে। বাঁহাতি মোহাম্মদ নেওয়াজকে আগে পাঠিয়েছিল পাকিস্তান, শানাকা আনেন অফ স্পিনার ধনাঞ্জয়া ডি সিলভাকে। এরপর রিজওয়ান যখন চামিকা করুনারত্নেকে ছয় মেরে গিয়ার বদলানোর ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তখনই আনেন তাঁর ট্রাম্পকার্ড ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গাকে, যিনি নিজের তৃতীয় ওভারে দিয়েছিলেন ১৪ রান।
হাসারাঙ্গা পাকিস্তানের বিপক্ষে আগের ম্যাচে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট, এবার ওই ওভারেই নিলেন ৩টি। ফিরলেন রিজওয়ান, আসিফ আলী, খুশদিল শাহ। শেষ ৩ ওভারে পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল এরপর ৫৯ রান, বাকি সব ব্যাটসম্যানকেই যেন হয়ে উঠতে হতো আফগানিস্তানের বিপক্ষে নাসিম শাহের মতো। সেটি হয়নি, পাকিস্তান খুঁজে পায়নি রূপকথার কোনো নায়ককে। ম্যাচের শেষ বলে উল্টো হারিস রউফকে বোল্ড করে শেষটা ‘পারফেক্ট’ করেছেন করুনারত্নে।
সেই রউফ, যাঁর গতিতে শ্রীলঙ্কা এলোমেলো হয়ে পড়েছিল শুরুতেই। শুরুটা অবশ্য করেছিলেন আগের ম্যাচে বিশ্রামে থাকা নাসিম শাহ। কুশল মেন্ডিস তৃতীয় বলেই গতির কাছে পরাস্ত হয়ে হন বোল্ড। এরপর পাতুম নিশাঙ্কা ও দানুশকা গুনাতিলাকা রউফের শিকার। টুর্নামেন্টে দ্বিতীয়বারের মতো বোলিং করতে আসা ইফতিখারও সফল হন, সফল শাদাব খানও।
৫৮ রানের মধ্যেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলা শ্রীলঙ্কাকে এরপর টেনে তোলার প্রথম কাজটা করে হাসারাঙ্গা ও রাজাপক্ষের জুটি। হাসারাঙ্গা ফিরেছিলেন ৫ ওভারের বেশি বাকি থাকতে, তবে ছিলেন রাজাপক্ষে। পাকিস্তানের গতির জবাব দিলেন, স্পিনের ওপর চড়াও হলেন। শ্রীলঙ্কাকে এনে দিলেন লড়াই করার মতো স্কোর। ৩৫ বলে ফিফটি করেছিলেন, পাকিস্তানের পিচ্ছিল ফিল্ডিংয়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত ৪৫ বলের অপরাজিত ইনিংসে ৬টি চারের সঙ্গে মারেন ৩টি ছক্কা।
নাসিম শাহর শেষ দুই বলে চার ও ছক্কা মেরে ব্যাটিং ইনিংসের শেষটা পারফেক্ট করেছিলেন রাজাপক্ষে। এরপর রউফকে বোল্ড করে ম্যাচের শেষটাও অমনই করলেন করুনারত্নে। হয়তো এ রাতটা, এশিয়া কাপটা হওয়ার কথা ছিল না তাঁদের।
তবে সবকিছু আজ নিজেদের করে নিল শ্রীলঙ্কা।
প্রথম আলো অবলম্বনে।